
নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতিতে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে আলু রপ্তানির নামে সরকারি প্রণোদনা আত্মসাতের ঘটনা। একদিকে কৃষকরা আলু বিক্রিতে চরম লোকসানে পড়েছেন, অন্যদিকে সরকারি রপ্তানি প্রণোদনার কোটি কোটি টাকা কাগুজে রপ্তানির মাধ্যমে উধাও হয়ে গেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জানিয়েছে, সরকারি রপ্তানি সহায়তার নামে প্রায় ৭ কোটি ৫৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে, যা কৃষি খাতে প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনার ভয়াবহ উদাহরণ।
স্থানীয় কৃষক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ বছর বীজ, সার, জমি ভাড়া ও শ্রম খরচ বেড়ে এক কেজি আলু উৎপাদনে গড়ে ১৭ থেকে ১৯ টাকা পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে। বাছাই, প্যাকেজিং ও হিমাগারে সংরক্ষণে অতিরিক্ত ৯ টাকা যোগ হয়ে প্রতি কেজিতে মোট খরচ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৫ থেকে ২৭ টাকা। অথচ হিমাগারে আলুর পাইকারি দাম এখন মাত্র ৮ টাকা, তাও ক্রেতা মিলছে না। ফলে কৃষকরা প্রতি কেজি আলুতে গড়ে ১৭ থেকে ১৯ টাকা ক্ষতির মুখে পড়ছেন।
এমন সময় সামনে আসে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য—রপ্তানির নামে সরকারি প্রণোদনার টাকা লোপাট। দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ‘অন্তরা কর্পোরেশন’ নামের একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠান ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৯৬টি ভুয়া বিল অব এক্সপোর্ট তৈরি করে। আধুনিক কাস্টমস সফটওয়্যার ‘অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেম’ ব্যবহার করে এই বিলগুলোর বিপরীতে সরকার ঘোষিত ২০ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা ব্যাংক থেকে তুলে নেওয়া হয়। প্রায় ৪৯ লাখ ৬৯ হাজার মার্কিন ডলার, অর্থাৎ ৭ কোটি ৫৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয় কোনো বাস্তব চালান ছাড়াই।
দুদকের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ জিন্নাতুল ইসলাম বাদী হয়ে গত ৩০ অক্টোবর দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মামলাটি দায়ের করেন। এতে চট্টগ্রাম কাস্টমসের বর্তমান ও সাবেক ১০ কর্মকর্তা এবং ৫ ব্যবসায়ীর নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তদন্তে দেখা যায়, “তাজা আলু রপ্তানি”-র নামে বিল অব এক্সপোর্ট দাখিল করা হলেও বাস্তবে কোনো চালানই পাঠানো হয়নি। পণ্য অফ-ডক এলাকায় প্রবেশ করেনি, কোনো জাহাজীকরণ ঘটেনি, এমনকি ব্যাংক নথি ও রপ্তানি সার্টিফিকেটও ছিল সম্পূর্ণ জাল।
দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভিযুক্তরা ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৬, ৪০৯, ৪২০, ৪৬৭, ৪৬৮, ৪৭১ ও ১০৯ ধারা, দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭-এর ৫(২) ধারা এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২-এর অধীনে মামলা হয়েছে।
দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, রপ্তানি প্রণোদনা ব্যবস্থায় তদারকির ঘাটতি ও প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণেই এই জালিয়াতি সম্ভব হয়েছে। ফলে কৃষি উন্নয়ন ও রপ্তানি বৃদ্ধির নামে বরাদ্দ কোটি কোটি টাকা বাস্তবে অল্প কিছু ব্যক্তি ও প্রভাবশালী চক্রের হাতে চলে যাচ্ছে, অথচ প্রকৃত কৃষকরা ক্ষতির ভার বইছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ৬২ হাজার ১৩৫ টন আলু রপ্তানি হয়েছে, যা গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। তবে কৃষকরা কোনো ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না, কারণ রপ্তানি আয় ও সরকারি সহায়তার বেশিরভাগই কেন্দ্রীয়ভাবে কিছু ব্যক্তি দখলে রেখেছে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এই ঘটনা প্রশাসনিক তদারকি ও জবাবদিহির অভাবের ভয়াবহ নিদর্শন। তারা বলছেন, প্রণোদনা ব্যবস্থায় যদি ডিজিটাল ট্র্যাকিং, স্বচ্ছ অডিট ও স্বাধীন নজরদারি নিশ্চিত না করা যায়, তবে ভবিষ্যতেও কৃষি খাতে এমন জালিয়াতি চলবে, আর তার ভার বইতে হবে দেশের প্রান্তিক কৃষকদেরই।